বউ পেটানোর মজা! আলোকিত মানুষ চাই- পর্ব ৪

বউ পেটানোর মজাআমি যখন ক্লাস এইট নাইনে পড়ি সে সময়কার একটি ঘটনা মনে পড়লো। সে সময় একবার আমার বড় বোন দুলাইভাই আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। আমাদের দুই তলা বাসার সাথে মেশানো একটি এক তলা বাড়ি আছে। এই বাড়ির মালিক থাকতোনা, সব রুম ভাড়া দেওয়া দেওয়া ছিল। এখানে ভাড়াটিয়া ভদ্রলোকটি প্রায় তার স্ত্রীকে মারধোর করতো! আমার বাবাকে অনেকবার সেই লোককে ডেকে এসব করতে নিষেধ করতে দেখেছি। আমার বোন দুলাভাই থাকা অবস্থায় একদিন ছোট দুই শিশু দৌড়ে আমাদের বাসায় আসলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, আমার মা কে বাঁচান। আমার বাবা আজকেও মা কে মারতেছে! শুনে আমার বাবা বললেন, আজকে এই লোকটির একটি বিহিত করতে হবে। এর ভিতর দেখা গেল আমার বড় দুলাইভাই উঠে দাঁড়িয়ে আশে পাশে তাকিয়ে একটি মোটা রড হাতে নিয়ে হাটা দিলো। সেই বাসায় যেয়ে ব্যাপক একটা মাইর দিলো সেই লোকটিকে। তারপর সেই বউ পিটানো লোকটিকে নিজে ডাক্তারের কাছে নিয়ে ঔষধ কিনে বাসায় নিয়ে আসে। অনেক বছর সেই পরিবারটি এখানে ছিল। আর কখনো সেই ব্যাক্তিটিকে বউ পিটাইতে দেখা যায়নি। তবে লোকটি আক্ষেপ করে বলেছিল, আপনারা কোরআন হাদিস জানা লোক হয়ে বউকে মারার অপরাধে শাস্তি দিলেন কিভাবে? বউকে মারার বিষয়টি জায়েজ আছে! অথচ সেই সময় একজন অপরাধীকে শাস্তি দিতে আমার মরহুম দুলাভাই এগিয়ে গিয়েছিলেন। আল্লাহ্‌ তাকে বেহেশত নফিস করুন। খুবই ভাল মানুষ ছিলেন তিনি।

২০০৫ সালে বিবিসি’র একটি খবরে দুনিয়া শিউরে উঠেছিল। ইরানের কোর্টে স্ত্রী আবেদন করেছিল তার স্বামীকে আদেশ দিতে যাতে সে তাকে প্রতিদিন না মেরে সপ্তাহে একদিন মারে, স্বামী দাবি করেছিল এ তার ইসলামি অধিকার। আল কোরআনের কোনো আয়াত নিয়ে এত দীর্ঘ সময় ধরে এত তর্ক- বিতর্ক হয়নি যা সুরা নিসা আয়াত ৩৪ নিয়ে হয়েছে, এবং হচ্ছে। আয়াতটার অনুবাদ এইভাবে করা হয়েছে −

“পুরুষরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল (কাওয়াম), কারণ আল্লাহ্‌ একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং কারণ তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে। সেই মতে নেককার স্ত্রীলোকগণ হয় অনুগতা, এবং আল্লাহ্‌ যা হেফাজত যোগ্য করে দিয়েছেন লোকচক্ষুর অন্তরালেও তার হেফাজত করে। আর যাদের মধ্যে অবাধ্যতার (নাসুজ) আশঙ্কা কর তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ কর এবং প্রহার কর (‘ইদ্রুবুহুনড়বা), যদি তাতে তারা বাধ্য হয়ে যায়, তবে আর তাদের জন্য অন্য কোন পথ অনুসন্ধান করো না।”

কোরআনের সুরা নিসার যে শব্দটির অনুবাদ “প্রহার করা” লেখা হয়েছে সেই একই শব্দ সুরা রা’দ আয়াত ১৭ তেও ব্যবহার হয়েছে। সেই আয়াতের অর্থ করা হয়ছে “এভাবেই আল্লাহ্‌ সত্য অসত্যের দৃষ্টান্ত প্রদান করেন।” সুরা রা’দ এ এসে দেখা যাচ্ছে প্রহারের যায়গায় অনুবাদ হিসাবে ‘দৃষ্টান্ত প্রদান’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে ‘মারপিট’ শব্দটা লাগালে এটা দাঁড়াবে : ‘এভাবেই আল্লাহ্‌ সত্য ও অসত্যের মারপিট করেন।’ এটি উদ্ভট কথা, তাই ‘ইদ্রুবুহুনড়বা’-র “দৃষ্টান্ত প্রদান” অর্থ ধরতে হবে।

শারিয়া-তত্তবগুরু শাহ্ আব্দুল হানড়বান বলেছেন, “ইসলামে কোনো স্ত্রী-প্রহার নেই, ওটা আয়াতের ভুল অনুবাদ ” ডঃ সুলায়মান বলেছেন নবীজী (সাঃ) বউ-পেটানোর বিরুদ্ধে এতই ক্রুদ্ধ ছিলেন যে তিনি ঘোষণা করেছিলেন কেউ স্ত্রী পেটালে যেন তাঁর সামনেই সে না আসে, অর্থাৎ তিনি তার মুখই দেখতে চান না।

ফাতিমা মার্নিসি তাঁর বইতে জানাচ্ছেন বউ-পেটানোতে শতাব্দী ধরে অভ্যস্ত সেই সমাজ এ-ঘোষণায় একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। ভক্ত মুসলমানদের জন্য এ ছিল যেন ফাঁসির আদেশ। বউকে প্রহার করা জায়েজের পক্ষে একটি হাদিস ব্যবহার হয়। হাদিসে আছে নবীজী মেসওয়াক করার সময় লোকেরা তাঁকে বৌ-পেটানোর পদ্ধতি জিজ্ঞেস করলে তিনি নাকি মেসওয়াকটা ঠুস করে গায়ে লাগিয়ে বলেছিলেন − ‘এভাবে।’ একটি ছোট মেসওয়াক দিয়ে কখনো প্রহার করা যায়না। বড়জোর একটা খুঁচা দেওয়া যায়।

ইসলামে বউ- পেটানোর উপরে কাজ করেছেন অনেক ইসলামি বিশেষজ্ঞ। এদের দেওয়া কিছু যুক্তি দেখলে মনে হয় আসলেই সুরা নিসার ৩৪ আয়াতের অনুবাদটা সঠিক হয়নি। তাদের অনেক যুক্তির ভিতর আমি কয়েকটা উল্লেখ করছি –

১. যে-ধর্মে আল্লাহ্‌- রসুলের প্রতি বাধ্যতায় জোর-জবরদস্তি নেই সে-ধর্মে স্বামীর বাধ্য হবার ব্যাপারে মারপিট হতে পারে না।

২. স্বামীও মানুষ, তারও ভুল হতে পারে। সে হতে পারে গাধার চেয়েও হাবা, সাপের চেয়েও বিষাক্ত, এবং নারী হতে পারেন মোমেনা ও বিশেষজ্ঞ।

৩. বাচ্চাদের সামনে বাবা তাদের মা’কে ধরে পেটানোর দৃশ্য অত্যন্ত কুৎসিৎ এবং বাচ্চাদের মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর। এ হিংস্রতা ও নোংরামিকে ইসলাম বৈধ করতে পারে না।

৪. আয়াতে এ-কথা বলা হয়নি যে স্ত্রীর ওপর স্বামী কর্তৃত্বশীল। বলা হয়েছে রেজাল (পুরুষ জাতি) নিসা (নারীজাতি)-র ওপর কর্তৃত্বশীল। কাজেই আয়াতটা পারিবারিক নয়, সামাজিক।

৫. আয়াতে আছে − “নেককার স্ত্রীলোকগণ হয় অনুগতা।” কার অনুগতা ? বিশেষজ্ঞরা বলেন এটা শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র প্রতিই। কেননা ইসলামে শর্তহীন পূর্ণ আনুগত্য শুধু আল্লাহ্‌ ও নবী রসুল ছাড়া আর কারো প্রতি হতে পারে না।

৬. দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রী দু’জনে দু’জনের কথা কাটাকাটি হবেই। কথা না শুনলেই যদি মারপিট হয় তবে ঘন ঘন হুলুস্থুল তাণ্ডবে সংসার শিকেয় উঠবে। ইসলামে তাই মারপিট বৈধ হতে পারে না।

রাসুল (সাঃ) এর বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রাঃ), তিনি অসংখ্য হাদিস বর্ননা করেছেন। তিনি নিশ্চই খুব ভাল করেই জানতেন স্ত্রীর অধীকার কতটুকু বা তার সাথে কেমন ব্যবহার করতে হবে এই বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা কি। আমরা খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) এর খেলাফত কালের একটি ঘটনা অনেকে জানি। আর একবার বলতে ইচ্ছা করছে- এক ব্যক্তির স্ত্রী ছিল বেশ মুখরা ও ঝগড়াটে। সব সময় সে স্বমীকে জ্বালাতন করত। স্বামী বেচারা স্ত্রীর দুর্ব্যবহারে অতিষ্ট হয়ে এ ব্যাপারে নালিশ জানাতে একদিন সে হাজির হল হযরত ওমর (রাঃ) এর দরবারে। সে হযরত ওমরের বাড়ির ফটকে দাঁড়িয়ে খলিফার বের হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল। এ সময় সে শুনতে পেল খলিফাকে তাঁর বিবি কঠোর ভাষায় বকাবকি করছেন। কিন্তু হযরত ওমর (রাঃ) কোন জওয়াব দিচ্ছেন না , বরং নীরবে সব শুনে যাচ্ছেন। এ ভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে লোকটি চলে যেতে উদ্যত হল। সে মনে মনে ভাবল, এমন প্রতাপশালী খলিফার যখন এমন হাল তখন আমি আর কোন ছাই। এমন সময় খলিফা বাড়ির বের হয়ে দেখতে পেলেন লোকটি চলে যাচ্ছে। তিনি লোকটিকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেনঃ “ কি হয়েছে, আপনি এলেনইবা কেন, আর কিছু না বলে চলে যাচ্ছেন কেন? লোকটি জওয়াব দিল, “হুজুর, আমার স্ত্রী আমার সাথে দুর্ব্যবহার করে , কথায় কথায় ঝগড়া করে । তার বিরুদ্ধে নালিশ করার জন্য আপনার দরবারে এসেছিলাম। কিন্ত দেখতে পেলাম আপনার হাল আমার চেয়ে ভাল নয়। তাই কিছু না বলেই চলে যাচ্ছি।” হযরত ওমর (রাঃ) বললেন : “শোন ভাই, আমার উপর আমার বিবি সাহেবার বেশ কিছু অধিকার আছে, আমি তাই তার এ বকাবকি সহ্য করছি। দেখ সে আমার খাবার রান্না করে, রুটি বানায়, কাপড় চোপড় ধোয় , বাচ্চাদেরকে দুধ খাওয়ায়। অথচ এ সব কাজ তার জন্য বাধ্যতামূলক নয়, সে স্বেচ্ছায়ই এ সব করে। এ সব কাজের জন্যে আমাকে যদি লোক রাখতে হতো তাহলে অনেক টাকা খরচ হতো। সেই সামর্থ্য আমার নেই। সে আমাকে হারাম উপার্জন থেকে বাচিয়ে রাখে। এখন বল আমি কি তাকে সহ্য না করে পারি?” লোকটি বললঃ “আমিরুল মুমিনীন,আমার বিবিও তো এরূপ। ” হযরত ওমর (রাঃ) বললেন , “তা হলে তাকে সহ্য করতে থাক, ভাই । দুনিয়ার জীবনটা তো নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী। ”

আসলে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা এমন, এখানে কে বড় আর কে ছোট এটা বিচার বিশ্লেষন করে চলতে গেলে সংসার করা যাবেনা। এখানে ছোট বড় হবার কোন বিষয় নেই। উভয় উভয়ের পোষাক স্বরূপ। স্বামী নামক পোষাকটি বেশি দামি নাকি স্ত্রী নামক পোষাক বেশি দামি এই হিসাব করতে যাওয়া শতভাগ বোকামী। হাস্যকরও বটে। একটি হাদিস দিয়ে শেষ করতে চাই।

রাসুল (সাঃ) বলেছেন, -“শুনে রেখো, তোমরা প্রত্যেকেই রাখাল বা প্রহরী। আর প্রত্যেককেই তার অধিনস্তদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। ইমাম বা নেতা যিনি শাসন করেন সাধারণ মানুষকে তাকেও তার অধিনস্তদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। একজন পুরুষ তার বাড়ির লোকদের রাখাল বা প্রহরী। তাকে তার অধিনস্ত লোকদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। নারী তার স্বামীর ঘরের লোকদের এবং সন্তানদের রাখাল বা প্রহরী। তাকে তার অধিনস্ত লোকদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।” (বোখারী, কিতাবুল আহকাম)

এখানে দেখা যাচ্ছে একজন পুরুষকে স্ত্রী ও সংসারের রাখাল বলা হয়েছে। আর স্ত্রী তার স্বামী বাদে বাড়ির অন্য সদস্যদের রাখাল বা প্রহরী বলা হয়েছে। প্রহরী আর মনিবের আচরণের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারলে সমস্যা হবার কথা নয়। পরিবার সুন্দর করতেও আলোকিত মানুষ হওয়া চাই। বউ পিটিয়ে সংসার সুন্দর করা যায়না। ভিতরের আলোটিকে বাহিরে বের করে আনতে পারলেই সকল অন্ধকার দূর করা সম্ভব।

লেখকঃ কমরেড মাহমুদ ভাই।

আরও পড়ুন : ভাগ্য ভালো কার?

প্রিয় পাঠক পাঠিকা, আলোকিত মানুষ গড়তে লেখকের বউ পেটানোর মজা শিরোনামের আর্টিকেলটি শেয়ার করুন। আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন। 

For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.

Leave a Comment