স্ত্রী যখন পাহারাদার (বীর নারীর গল্প)

স্ত্রী যখন পাহারাদার, লেখক এক বীর নারীর জীবনের গল্প তুলে ধরেছেন যিনি তাঁর বুদ্ধি ও অসীম সাহস দিয়ে স্বামীকে শত্রুর প্রাণ বিনাশের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। 

স্ত্রী যখন পাহারাদার | The story of a heroic woman

স্ত্রী যখন পাহারাদারমুসলিম বিরঙ্গনা চাঁদ সুলতানা। তিনি ছিলেন আহমদ নগর এলাকার নবাবের কন্যা। তাঁর পিতা তাঁকে যোগ্য শিক্ষক মন্ডলির মাধ্যমে অল্প বয়সেই লেখাপড়া ও যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী করে তুলেছিলেন। ফলে আশ্বারোহন, তলোয়ার চালনা ও তীর-বল্লম নিক্ষেপসহ প্রভৃতি যুদ্ধাস্ত্র চালনা ছিল তাঁর জন্য খুবই সহজসাধ্য ব্যাপার।

বিয়ের বয়সে উপনীত হওয়ার পর রেজাপুরের নবাব আদিল শাহ তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। তাঁর পিতা অত্যন্ত আনন্দের সাথে উক্ত প্রস্তাব গ্রহন করেন এবং যথাসময়ে তাদের শুভ বিবাহ সম্পন্ন করেন।

একবার এই চাঁদ সুলতানার স্বামী আদিল শাহ গোপন সূত্রে সংবাদ পেলেন যে, রাজ দরবারের কতিপয় আমলা তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছে। এই ভয়ানক দুঃসংবাদ অবগত হওয়ার পর মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। এদিকে বহু অনুসন্ধান করার পরও ষড়যন্ত্রকারীদের পরিচয় উদ্ধার করা গেল না। ফলে দিনদিন তাঁর উদ্বেগ – উৎকণ্ঠা বেড়েই চলল।

এদিকে বুদ্ধিমতি স্ত্রী টের পেলেন, তাঁর স্বামী কি কারণে যেন হতাশ, নিরুদ্যম ও আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন। তাঁর এখন ভালো ঘুম হয় না এবং প্রায়ই ঘুমেই চমকে উঠেন। একবার এ প্রসঙ্গে তিনি স্বামীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। কিন্তু কোনো উত্তর পাননি। ফলে চাঁদ সুলতানা নিজেও ভীষণ পেরেশান হয়ে পড়লেন।

অবশেষে একদিন তিনি স্বামীকে জোর দিয়েই বললেন যে, আজ আপনাকে অবশ্যই বলতে হবে, আপনার কী হয়েছে? কেন আপনি এতটা ভেঙ্গে পড়েছেন? কেন আপনার এই বিপর্যস্ত অবস্থা?

স্বামী আদিল শাহ স্ত্রীর চাপাচাপিতে না বলে পারলেন না। তাই সবকিছু খুলে বললেন।

চাঁদ সুলতানা বিস্তারিত শুনে স্বামীকে অভয় দিয়ে বললেন, প্রিয়তম!

আপনি একদম নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে বলছি, আমি জীবিত থাকতে কোনো বীর-বাহাদুর আপনার কোনো ক্ষতি করবে দূরের কথা, আপনার একটি পশমও স্পর্শ করতে পারবে না। আজ থেকে আমি নিজে আপনার পাহাদার দায়িত্ব গ্রহন করলাম। তাই এখন থেকে আপনি নিশ্চিন্তে, নির্ভাবনায় নিদ্রা গ্রহন করবেন।

সেদিন থেকে পতিপ্রাণা স্ত্রী চাঁদ সুলতানা নিজের আরামের ঘুমকে হারাম করে সারারাত জেগে স্বামীকে পাহার দিতে থাকেন। অনেক দিন এভাবে অতিবাহিত হওয়ার পর একদিন তিনি গভীর রাতে ছাদের উপর কিসের যেন একটা শব্দ শুনতে পেলেন। পরপর কয়েকবার এই শব্দ শোনার পর তিনি ছাদের উপর মানুষের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হলেন। অতঃপর তিনি অতি সন্তর্পণে তলোয়ার হাতে ছাদে উঠলেন। ছাদের দরজার ফাঁকে চোখ রেখে তিনি দেখতে পেলেন, দু’জন মুখোশধারী ব্যক্তি নগ্ন তরবারী হস্তে ধারণ করে পরস্পর ফিসফিস করে কী যেন পরামর্শ করছে।

তিনি আর সময় নষ্ট করলেন না। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে দরজা খুলে চোখের পলকে ছাদে প্রবেশ করলেন। তাঁকে দেখামাত্রই মুখোশধারীরা একযোগে তাঁর উপর ঝাপিয়ে পড়ল।

চাঁদ সুলতানা ছিলেন একজন কুশলী যুদ্ধা। তিনি জানতেন, কী করে শত্রুর আক্রমণ থেকে নিজকে বাঁচাতে হয়। কী করে পাল্টা আক্রমণ চালাতে হয়। শত্রুরা যখন তাঁর দিকে দ্রুতবেগে ধেয়ে আসছিল ঠিক তখনই তিনি পিছনে সরে এলেন এবং দেহের সমস্ত শক্তি একত্র করে আচমকা তাদের একজনের উপর আক্রমন করে বসলেন। এতে লোকটির দেহ দ্বিখণ্ডিত হয়ে দু’দিকে ছিটকে পড়ে তপড়াতে শুরু করল।

এই ভয়ানক দৃশ্য দেখে অপর আততায়ী প্রাণ নিয়ে পালাতে চেয়েছিল। কিন্তু বীরঙ্গণা চাঁদ সুলতালা তরবারীর এক আঘাতে তাকেও জমালয়ে পাঠিয়ে দিলেন।

ছাদের উপর থেকে আওয়াজ শুনে নবাব আদিল শাহের ঘুম ভেঙ্গে গেল। তিনি দেখতে পেলেন , ঘরে তাঁর স্ত্রী নেই। আওয়াজ শুনে ততক্ষণে কয়েকজন প্রহরীও দৌড়ে এসেছিল। আদিল শাহ তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে খুব দ্রুত ছাদে গেলেন। সেখানে গিয়ে তারা যে দৃশ্য দেখলেন, তাতে তাদের সবার চোখ স্থির হয়ে গেল।

এসময় স্বামীর দিকে এগিয়ে এসে স্ত্রী চাঁদ সুলতানা মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। বললেন, সমস্ত প্রশংসা ঐ আল্লাহর জন্য যিনি আমার ওসিলায় আপনার জীবন রক্ষা করলেন। আর আমাকে সুযোগ দিলেন স্বামীর সামান্য খেদমত করার জন্য।

আদিল শাহ তখন এগিয়ে এসে স্ত্রীর রক্তমাখা তরবারীতে চুম্বন করে ঘোষণা করলেন, ইনশা আল্লাহ আমার চাঁদ জীবিত থাকতে সমস্ত দুনিয়াও যদি আমার শত্রুতে পরিণত হয়, তবু আমার কোনো ভয়ের কারণ নেই।

প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! এই হলো স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালোবাসার  অপূর্ব নমুনা! স্বামীর বিপদের কথা শুনে তাঁর হেফাযতের জন্য তিনি নিজেই পাহারাদারীর দায়িত্ব গ্রহন করলেন। রাতের বেলা না ঘুমিয়ে নিজেই সতর্ক থাকলেন যে, না জানি কোনো ষড়যন্ত্রকারী এসে তাঁর প্রেমাস্পদকে হত্যা করে। অতঃপর নিজেই জীবনের ঝুকি নিয়ে স্বামীর শত্রুদেরকে হত্যা করেলন। ওহ! স্বামীর জন্য স্ত্রীর কতবড় কুরবানী। কতবড় ত্যাগ!! আল্লাহ পাক জগতের সকল স্বামী – স্ত্রীকে পরস্পরের জন্য এরূপ ত্যাগ ও কুরবানীর অনুপম নযীর স্থাপন করার তাওফীক দান করুণ। আমীন। [সূত্র মাশাহীরে নিসওয়ান, খাওয়াতীনে ইসলাম কী বাহাদুরী]   

লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম। লেখকের আদর্শ স্বামী স্ত্রী ২ বই থেকে। 

এরপর পড়ুন :  স্ত্রীর আকাঙ্খা ও প্রয়োজন পূর্ণ করুণ

প্রিয় পাঠক পাঠিকা, লেখকের স্ত্রী যখন পাহারাদার গল্পটি পড়ে ভালো লাগলে এটি আপনার বন্ধুদেরকে পড়াতে শেয়ার করুন। 

For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.

Leave a Comment