অশিক্ষিত স্বামী মুখরা স্ত্রী (স্বামী স্ত্রীর গল্প)

অশিক্ষিত স্বামী মুখরা স্ত্রী (স্বামী স্ত্রীর বাংলা গল্প)

মুখরা স্ত্রীএক গ্রাম্য লোক। অশিক্ষিত। মোটেও লেখাপড়া জানে না। কয়েক বছর হলো হলো বিয়ে করেছে। বউ বেশ সুন্দরী। তবে মুখরা। বদদীন ও কর্কশ স্বভাবের। স্বামীর সাথে কথা বলার নিয়ম-কানুন জানে না। সব সময় কেবল মেজাজ দেখায়।

লোকটি মূর্খ বটে, তবে সহজ সরল। সেই সাথে আবার দীনদারও।

একদিন লোকটি কোনো এক কাজে বাড়ি থেকে বের হয়। যেতে যেতে উপস্থিত হয় এক মাওলানা সাহেবের বাড়িতে। সুযোগ পেয়ে মাওলানা সাহেব তাকে কিছু উপদেশ দেন। আমলের কথা বলেন। আর সবশেষে ফজীলত বর্ণনাসহ দরূদ শরীফের অযীফা বাতলে দেন।

দরূদ শরীফের অযীফা লোকটির খুব মনোপুতঃ হয়। সে বাড়ী এসে অযীফা আদায় শুরু করে। এবং ধীরে ধীরে এমন আন্তরিকতা ও মহব্বতের সাথে দরূদ শরীফ পাঠে মগ্ন হয়ে পড়ে যে, দুনিয়াবী কাজকর্ম করার কথাও ভুলে যায়।

স্ত্রী তো এমনিতেই মুখরা। তাঁর উপর স্বামীর এই অবস্থা! সে তাঁর স্বামীকে যখনই দেখে তখনই তাঁর মুখ থেকে এই জপ শোনে-

“সাল্লি আলা মুহাম্মদ’ সাল্লি আলা মুহাম্মদ’।

সুতরাং স্ত্রীর রাগ এবার দেখে কে? সে বাঘিনীর মতো স্বামীর দিকে তেড়ে যায়। আর বলে-দুর্ভাগা! এবার এই “সাল্লি আলা” ছেড়ে কাজকর্ম করো। কামাই রোজগারে হাত দাও।

স্ত্রীর কথায় স্বামী কোনো জবাব দেয়নি। তাঁর বাজে ব্যবহারে মোটেও দমে যায়নি। বরং তাঁর কণ্ঠে সদা সেই “সাল্লি আলা মুহাম্মদ”-এর মধুময় সুরই বাজতে থাকে। আর বাজবেই না কেন? একবার যে ব্যক্তি দরূদের অপূর্ব স্বাদ, বর্ণনাতীত মজা লাভ করেছে, কীভাবে সে এই জপ ছাড়তে পারে?

কয়েকদিন পরের কথা। এক ব্যবসায়ী লোকটির কাছে একশ টাকা পেত। টাকা আদায়ে বিলম্ব হওয়ায় একদিন সে আদালতে গিয়ে মামলা করে। স্ত্রী একথা শুনে স্বামীকে “সাইজ” করার আরেকটা সুযোগ পেয়ে যায়। সে এবার প্রাণখুলে বকাঝকা করতে থাকে। মুখ দিয়ে যা এল তা-ই বলে। অথচ একটিবারের জন্যও ভাবেনি যে, আমি যাকে কটু কথা বলছি, যাকে গালি দিচ্ছি-তিনি আর যাই হোন, স্বামী তো বটে! স্বামীকে কি এভাবে শক্ত কথা বলা যায়? তাকে কি গালিগালাজ করা যায়? তাঁর সাথে কি বেয়াদবীমূলক কথা বলা যায়? তাঁর মনে কি আঘাত দেওয়া যায়?

স্ত্রীর এতসব উচ্চবাচ্যের পরও স্বামী বেচারা আগের মতোই নীরব। স্ত্রীকে সে কিছুই বলল না। তবে রাতের শেষ প্রহরে উঠে মহান আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি জুড়ে দিল। বলল-ব্যবসায়ীর দেনার কথা। বলল–স্ত্রীর দুর্ব্যবহারের কথা।

মহাপ্রভুর দরবার–যেখানে সত্যিকার অর্থে চাইতে পারলে কেউ ফিরে না–সেখানে সে কেদে কেদে বলল–হে আল্লাহ! তুমি তো সকল বিপদগ্রস্থের আশ্রয়স্থল। তুমিই মানুষের অভাব মোচন কর। তুমিই তাদের বিপদ-আপদ দূর কর। তুমি ছাড়া এই ক্ষমতা এই ক্ষমতা আর কারো নেই খোদা। ওগো দয়ালু মাওলা! তুমি আমার অভাব দূর করে দাও। আমার আঁধারঘন এই সংকটকালে মুক্তির পথ বের করে দাও।

আল্লাহ তাআলা বান্দার চোখের পানি খুব পছন্দ করেন। বিনয়-নম্রতাকে ভালোবাসেন। তি আর কান্নার ফলে আল্লাহর রহমতের দরিয়ায় জোস এল। আর সেই রহমত যখন তাঁর উপর বর্ষিত হলো তখন সে ঘুমিয়ে পড়ল।

লোকটি এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ সে স্বপ্নে দেখে-তার কাছে আগমন করেছেন এক অপূর্ব সুন্দর আলোকিত পুরুষ। বড়ই মমতা ও আদরের সাথে তিনি বলছেন–ভয় পেয়ো না। ঘাবড়াবার কিছু নেই। আল্লাহর রহমতে আমিই তোমাকে সাহায্য করব।

সে বলল, আপনি কে? আমি তো আপনাকে চিনি না।

জবাব এল, আমি সেই নবী যার উপর তুমি দরূদ পড়। সুবহানাল্লাহ।

একথা শুনে লোকটি খুশিতে বাগবাগ হলো। আনন্দে আত্মহারা হলো। গোটা হৃদয় প্রশান্তিতে ভরে ওঠল। সেই সাথে দূরীভূত হলো যাবতীয় অস্থিরতা। দূর হলো দেনা পরিশোধের চিন্তা।

যাওয়ার সময় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন-আগামীকাল সকালে তুমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবে। বলবে, আপনার পঠিত অযীফা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছে।

সকালে উঠে ছেঁড়া-ফাটা পোষাক যা ছিল, তা-ই পরিধান করে রওয়ানা দিল লোকটি। গন্তব্য–প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন। আর উদ্দেশ্য-প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ।

লোকটি মন্ত্রী মহলের ফটকে যেতেই বাধা দিল দারোয়ান। জিজ্ঞেস করল-কোথায় যাবে তুমি?

 সে বলল, আমি মন্ত্রীর সাথে দেখা করতে চাই।

বাহ! বেশ তো। এই পোষাক নিয়ে মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ! ভাগো এখান থেকে থেকে। এ বলে দারোয়ান তাকে অপমান  করে তাড়িয়ে দিতে চাইল।

এই ঘটনা দূর থেকে লক্ষ্য করল এক আল্লাহওয়ালা কর্মচারী। লোকটির অবস্থা দেখে তাঁর দয়া হলো। তাই সে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ভাই! কী চাও তুমি?

জবাবে লোকটি বলল, আমি প্রধানমন্ত্রীর সাথে একান্তে মিলিত হতে চাই।

কর্মচারী মন্ত্রী মহোদয়কে খবর দিল। মন্ত্রীও তাকে সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে ডেকে নিল। যখন উভয়ে নির্জনে মিলিত হলো তখন সে পূর্ণ কাহিনী মন্ত্রীকে শোনাল। সেই সাথে মন্ত্রীর অযীফা যে আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছে সেকথাও বলল।

এ সুসংবাদ শুনে মন্ত্রী মহোদয় এতটাই খুশি হলেন যে, সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজ পকেট থেকে তিনশ দিরহাম বের করে লোকটির হাতে তুলে দিলেন। এবং বললেন, এগুলো আমার পক্ষ থেকে হাদিয়া।

লোকটি বাড়িতে এসে দিরহাম গুলো স্ত্রীর হাতে তুলে আবার দরূদ শরীফের অযীফায় মগ্ন হলো। বারবার পাঠ করতে লাগল-সাল্লি আলা মুহাম্মদ, সাল্লি আলা মুহাম্মদ।

আর স্ত্রী? সে তো এতগুলো দিরহাম একসাথে দেখে আনন্দে নাচতে শুরু করল। বলল, এবার তুমি “সাল্লি আলা” যত পারো পড়ো। আমি আর তোমাকে কিছু বলব না।

দিরহাম পেয়ে ঘরের অভাব দূর হলো। দুঃখ-দুর্দশা লাঘব হলো। এবার দেনা পরিশোধ পালা।

নির্ধারিত তারিখে একশ দিরহাম হাতে নিয়ে আদালতে হাজির হলো লোকটি। পেশ করল বিচারকের সামনে। এমন সময় পাওনাদার ব্যবসায়ী সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলে ওঠল-মাননীয় আদালত! আমার বুঝে আসছে না–যার বাড়িতে রুটির কোনো ব্যবস্থা নেই, যে একটি নতুন কাপড় কেনার সামর্থ রাখে না, তাঁর হাতে একশ দিরহাম কোত্থেকে এল? আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, এই দিরহামগুলো সে কারো কাছ থেকে চুরি করে এনেছে।

ব্যবসায়ীর কথায় বিচারকের মনে সন্দেহের দানা জমাট বেঁধে ওঠল। তাই তিনি লোকটিকে পরীক্ষা করার জন্য ধমক দিয়ে বললেন–বলো, এই অর্থ কোথায় পেয়েছ? নইলে এক্ষুণি তোমাকে বন্দি করে কয়েদখানায় আবদ্ধ করব।

লোকটি স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করুন। কারণ, তিনি খুব ভালো করে জানেন যে, এই টাকা আমি কোত্থেকে পেয়েছি।

বিচারক সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রী বরাবর চিঠি পাঠালেন।

উত্তরে মন্ত্রী মহোদয় লিখলেন–এ লোকের সাথে কোনো বেআদবী হলে সঙ্গে সঙ্গে তোমাকে বহিস্কার করা হবে।

মন্ত্রী মহোদয়ের কথা শুনে বিচারক ভয় পেয়ে গেলেন। লোকটিকে কাছে ডেকে নিজের আসনে বসতে দিলেন। তারপর তাঁর মুখ থেকে পুরো কাহিনী শ্রবণ করলেন।

কাহিনী বলা শেষ হলে বিচারকের কাছে লোকটির গুরুত্ব আরো বেড়ে গেল। তাই তিনি লোকটিকে খুব আদর-আপ্যায়ণ করলেন। সমাদর করলেন। তারপর একোশ দিরহাম লোকটির হাতে ফেরত দিয়ে ব্যবসায়ীর পাওনা নিজের পকেট থেকেই পরিশোধ করলেন।

এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে ব্যবসায়ীরও টকন নড়ল। ভাবল, যে লোক নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে স্বপ্নে দেখেছেন, তদুপরি যার সাথে রয়েছেন-মন্ত্রী আর হাকীম, তাঁর সাথে কি লড়াই করা যায়? যায় কি কোনো অসৌজন্যমূলক আচরণ করা? তাই সে পূর্বের বক্তব্যের জন্য সীমাহীন দুঃখ প্রকাশ করল। সেই সাথে একশ দিরহাম লোকটিকে দিয়ে বলল, আমার আর দিরহামের প্রয়োজন নেই। আপনিই এগুলো নিয়ে যান। উপহার স্বরূপ এ সামান্য অর্থ গ্রহণ করে আমাকে কৃতার্থ করুন।

প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! যে লোকের ঘরে রুটি-রুজ্জির কোনো ব্যবস্থা ছিল না, যে লোককে মন্ত্রী-মহলের গেইট থেকে অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, যে লোকের ছিল না দেনা পরিশোধের কোনো প্রকার সামর্থ, উপরন্তু যে লোকের স্ত্রী ছিল বদমেজাজী–সেই লোককে আল্লাহ পাক দরূদ শরীফ আর কান্নাকাটির বদৌলতে অসীম সম্মান দিলেন, প্রিয় নবীর দর্শন লাভে ধন্য করলেন, মন্ত্রী-আর বিচারকের প্রিয়ভাজন বানালেন, অভাব-অনটন দূর করলেন, একশ দিরহামের দেনা পরিশোধ করতে গেলে দুইশ দিরহাম পকেটে দিয়ে বাড়ি ফিরালেন। শুধু তাই নয় মুখরা স্ত্রীকেও ঠাণ্ডা করলেন। তাই আসুন, দরূদ শরীফের এই আমলকে আমরাও মজবুত করে ধরি। নবীজির মহব্বত নিয়ে খুব বেশি পরিমাণে দরূদ শরীফ পাঠ করি। সেই সাথে শেষ রাতে উঠে দু’ফোটা চোখের পানি ফেলার চেষ্টা করি। হে মহান সৃষ্টিকর্তা করুণাময় মাবুদ! তুমি আমাদের তাওফীক দাও। আমীন। [সহায়তায়ঃ ওয়াজে বেনযীর]

লেখকঃ মাওলানা মুফীজুল ইসলাম। (আদর্শ স্বামী স্ত্রী ১)

এরপর পড়ুন : নববধূর নতুন জামা

প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, লেখকের অশিক্ষিত স্বামী মুখরা স্ত্রী গল্পটি পড়ে যদি ভালো লাগে তাহলে এটি অবশ্যই আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন এবং আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন। 

For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.

Leave a Comment